| রোগমুক্তির অন্যতম সোপান হিসেবে ভাবা হয় ‘যোগা’ প্রক্রিয়াকে। ‘যোগ’ কথাটার উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শব্দ ‘যুজ’ কথা থেকে যার অর্থ হল সংযোগ বা মিলন। এর উদ্দেশ্য হল মনের একাত্মতা বা মনসংযোগ বাড়ানো। আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভারতবর্ষেই বিশিষ্ট ঋষি পতঞ্জলী তাঁর ‘যোগসূত্রে’ এর বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে গেছেন। ঋষি পতঞ্জলী তাঁর ‘যোগসূত্রে’ আটটি পথের কথা বলেছেন। যাকে বলা হয় ‘অষ্টম মার্গ’ বা ‘আটটি হাত’। যাঁরাই প্রতিদিন যোগাভ্যাস করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে দেহের গড়ন সুন্দর হয়, গায়ের সঙ্গে মানসিক জোর বাড়ে, সেইসঙ্গে আচার-আচরণের নমনীয়তা লক্ষ্য করা যায়। বন্ধুত্ব মনোভাব আসে। পরের জন্যে কিছু করার জন্যে ব্যাকুল হয় ও আত্মপ্রত্যয় বাড়ে। যারজন্যে তাঁর মধ্যে সবসময় ধীরস্হির ও সুস্হতার লক্ষণ ফুটে ওঠে সারা দেহমন জুড়ে। যিনি সারাবছর ধরে যোগাভ্যাস করে যান, তাঁর জীবনশৈলীর মধ্যে এক দারুণ পরিবর্তন আসে, তিনি স্হিতথী হন, আত্মবিশ্বাসী হন, অফুরন্ত ক্ষমতার অধিকারী হন ও অনাবিল আনন্দ ঝর্ণার মধ্যে ডুবে থাকেন। প্রতিনিয়ত যোগাভ্যাস মন ও শরীরের মধ্যে একটা সুন্দর সমতা রাখতে সাহায্য করে। ভয়-ভীতি উধাও হয়ে যায়। যে কোন কঠিন পরিস্হিতিতে মুখোমুখি হতে ভয় পায় না, তার সমাধান করতে পারেন। যোগাভ্যাসে প্রণিত চারটে সূত্র কাজ করে। প্রথমটি হল আমাদের এই দেহ ভান্ড। যেটার বাইরে রয়েছে মস্তবড় ব্রক্ষ্মান্ড। দেহ বা ভান্ডের মধ্যে অহরহ ঘটে চলেছে নানা বিপাকীয় কার্য যেমনটা ঘটে চলেছে তার চারপাশের ব্রক্ষ্মান্ডে। একের অনুভূতি অন্যের অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। তাই দেহের সুস্হতা বা দেহের অসুস্হতা নির্ভর করে ভান্ড ও ব্রক্ষ্মান্ডের কার্যকারিতার সমতার ওপরে। দ্বিতীয় সূত্র হল ব্যক্তিবিশেষের দৈহিক ও মানসিক চাহিদার সামঞ্জস্যের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব হলে সুস্হতা ও অসুস্হতার মধ্যেও তারতম্য ঘটে যেতে পারে। তৃতীয় সূত্র হল যোগাভ্যাসের মাধ্যমে আত্মক্ষমতার বিকাশ ঘটে। যারজন্যে নিজস্ব ক্ষমতার বলে সে অসুস্হতা কাটিয়ে উঠে সুস্হতায় ফিরে যেতে পারে। বাইরে থেকে তার কোন সাহায্যের দরকার হয় না। চতুর্থ সূত্র হল মানসিক ক্ষমতারও বিকাশ ঘটে যোগাভ্যাসের মাধ্যমে। সৎচিন্তা, সৎকার্য মনের ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। উন্নত মন সুস্হতার পক্ষে সহায়ক হয়। আবার অসুস্হ মন রোগের বিকাশ ঘটাতে বেশ সাহায্য করে, সুস্হতাকে আনতে সময় বেশি লাগায়। বিদেশীরা জোর দেন হঠযোগ ও ধ্যানের ওপর। হঠযোগ হল নানান ধরণের আসন ও প্রাণায়াম যার মাধ্যমে দেহকে সুস্হ রাখার চেষ্টা করা। এরফলে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা জনিত যে সমস্ত অসুখ দেখা যায় যেমন হৃৎরোগ, ক্যান্সার, স্ট্রোক, হাঁপানী ও অন্যান্য দীর্ঘায়িত অসুখ-বিসুখের প্রকোপকে হঠযোগাভ্যাস সহযোগে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এছাড়া যোগাভ্যাসের মাধ্যমে দেহের পেশীকোষের ক্ষমতা যেমন বাড়ে তেমনি দেহের সহনশীলতাও বাড়ে। এরসঙ্গে হৃৎযন্ত্র, শ্বাসযন্ত্রের কার্যকারিতা ক্ষমতা বাড়ে। দুশ্চিন্তা,অবসাদ, আসক্তি দূর করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দেহের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে, মানসিক উন্নতির জন্যে ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।এককথায় ফুরফুরে দেহমনে উজ্জীবীত হলে দেহের আয়ুশক্তিও বেড়ে যায়। যাঁরা খুবই অবসাদে অথবা দুঃশ্চিন্তায় কিংবা অনিদ্রায় ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নিয়মিত যোগাসন ও ধ্যান মন্ত্রের মতন কাজ করে। এরফলে দুশ্চিন্তা কমে, হৃৎস্পন্দন কমে, শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে বয়, রক্তের চাপ কমে যায় ও হৃৎযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়। নিয়মিত যোগাভ্যাসের ফলে সেরোটনিন নিউরোহরমোন ক্ষরণ বাড়ে ও মনোএ্যামাইনো অক্সিজেন নামক উৎসেচকের মাত্রাকে কমিয়ে দেয় ও কর্টিসোন হরমোনের মাত্রাও কমিয়ে দেয় যেগুলো দুশ্চিন্তা কমানোর অন্যতম সহায়ক। এছাড়া যোগাভ্যাস পেশীর ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। পেশীকে নমনীয় করার দরুণ বাতরোগ, হাড়ের ক্ষয় ও পিঠের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। একটানা নিরবিচ্ছিন্ন যোগাভ্যাসের ফলে দেহের ক্লান্তি কমে যায়, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, শ্বাসযন্ত্রের কাজের ক্ষমতা বাড়ে। রক্তে হেমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ে, রক্তে তঞ্চন হওয়ার প্রবণতা কমে গিয়ে ব্রেণ স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমে যায়।এছাড়া যোগাভ্যাস দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে রোগ-ভোগকে ঠেকাতে সাহায্য করে।যদিও এটা ক্যান্সার নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে না পারলেও তা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। মাতৃজঠরে শিশু যোগাভ্যাসেই দিন কাটাতো। শীর্ষাসন অবস্হায় তার ছিল ঠাঁই মাতৃজঠরে। জন্মের পরে মায়ের সঙ্গে দেহ থেকে ছিন্ন হওয়ার পরেই দেহবস্হান পরিবর্তনে তার প্রথম প্রতিবাদ কান্নার মাধ্যমে। এরপরে ভূমিষ্ঠ হওয়ার থেকে তার বাড়তে থাকে স্ট্রেস দিনের পর দিন নানাভাবে। তাই শিশু অবস্হায় তাকে সহজ সরল যোগাভ্যাস করালে তার এই স্ট্রেস কমানো সম্ভপর হয় ও যুবা ও পরিণত বয়সে এমনকি বৃদ্ধ বয়সে এই যোগাভ্যাস তাকে সুঠাম,সুদেহ,তরতাজা,কর্মচঞ্চল ও শান্তভাব দিতে পারে। সেখানে তাকে নিরাময়ে রাখতে পারে নানান অসুখ-বিসুখের হাত থেকে। আমাদের মা-ঠাকুরমা- দিদিমারাও পুজোর ছলে ও জপের মাধ্যমে যোগাভ্যাস চর্চা করে গেছেন সকলের অগোচরে। তাঁদের আয়ুঃকাল বৃদ্ধিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। উল্টোটা দেখা যাচ্ছে আজকালকার নব্য মহিলাদের মধ্যে সেই অভ্যাসের ঘাটতি থাকায় ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটায় নব্য মহিলাদের রোগ-ভোগের সংখ্যাও দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে।তাই নিয়মিত যোগাভ্যাসই হল বর্তমান ঝঞ্ঝ-সংকটময় জগতে একমাত্র পথের দিশারী। | |